একজন অধ্যাপক  তপন রুদ্র এবং তার দর্শন | সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক
একজন অধ্যাপক  তপন রুদ্র এবং তার দর্শন   |  সরদার মোহম্মদ  রাজ্জাক

 

সাহিত্যের জরায়ুতে সামাজিকতার স্বরূপ উদঘাটন নিতান্তই অতি সাধারণ কিন্তু স্থিতি প্রথম অর্থে মৌহুর্তিক দ্বিতীয় অর্থে চিরকালের- অনশ্বর। মৌহুর্তিক এজন্যে যে, সামাজিকতার প্রশ্নে সাহিত্য তার অনেক উর্দ্ধে, সামাজিকতার মৌলিকত্ব কোন ভাবেই সাহিত্যে-সিদ্ধ স্বীকৃতির অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সাধারণভাবে অপেক্ষা না রাখলেও সাধারণতার বাইরে  মূলগতভাবে স্থিতিশীলতা হয়ে যায় চিরকালের। কেননা মৌহুর্তিক চিন্তা প্রবাহে চকিত বিদ্যুৎ পতনের মতো সামাজিকতার আর্বিভাব ক্ষণস্থায়ী হলেও তার যে অনুরণন তাকে কখনই অস্বীকার করতে পারে না সাহিত্য। বরং সাহিত্যের মুক্ত চিন্তা স্রোতকে সামাজিকতার ওই অস্পষ্ট অনুরণন আকর্ষিত করে সাহিত্যকে প্রতিক্ষণে। সেদিক থেকে আরো বিশ্লেষণ করলে বলা যাবেÑ যেহেতু সাহিত্যের মূল সম্পর্ক ব্যক্তিক মূল্যবোধের সাথে অতি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত সেইহেতু সাামজিকতার অনেক উর্দ্ধে অধিষ্ঠিত থেকেও সাহিত্য সামাজিকতার প্রথম নিরীক্ষণকারী। অর্থাৎ ব্যক্তিক মূল্যবোধকে অবিরাম সক্রিয় রাখবার দায়িত্বেই সাহিত্য সামাজিকতার চরিত্র নিরীক্ষায় উন্মুখ।

ব্যক্তিক জীবনের সাথে যদি সাহিত্যের সম্পর্ক অনিশ্চিত হতো তবে হয়তো ভিন্ন বোধের সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কিন্তু যেখানে জীবনই সাহিত্যের উৎসনির্ঝর সেখানে অন্যকিছুর কল্পনা শুধু অবান্তর নয় রীতিমতো অর্থহীনও। অবশ্য এখানেও একটা প্রশ্ন উত্থিত হতে পারে সামজিকতাও তো জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, কিন্তু তা না হলেও নির্দিষ্টতায় সীমাবদ্ধ। এবং সীমাবদ্ধ বলেই সাহিত্যের মুখ্য লক্ষ্য সামাজিকতায় নয়- অতি স্পষ্টভাবে ব্যক্তি-জীবনে। ব্যক্তি- জীবনের মূল্যবোধের মুক্তায়নের স্বার্থেই দৃষ্টি সামাজিকতায় আকৃষ্ট।

কথাগুলি বলা হলো কেবলমাত্র অধ্যাপক তপন রুদ্রের চিন্তাবৃত্তির মৌলিক উৎসটিকে সূর্যের প্রখর আলোকে দৃশ্যমান করে তাঁর চিন্তা প্রবাহের গতি প্রকৃতিকে ব্যপকভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে উদ্ভাসিত করবার জন্যে। মূলতঃ তপন রুদ্র ছিলেন একজন শিক্ষক। গভীর বিশ্লেষণে তিনি শুধুমাত্র একজন শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন তাঁর কর্মের প্রতি প্রচন্ড দায়িত্বশীল অত্যন্ত তীক্ষ্ন মেধার বিরল প্রতিভাধর একজন নিবেদিত শিক্ষক। তিনি শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত সহযোগী অধ্যাপক পদের দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করে অবসর গ্রহন করেন। যেহেতু তিনি সরকারি পদে দায়িত্বরত ছিলেন সেইহেতু কিছু কিছু বিষয়ে মতামত প্রদান অথবা প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর যথেষ্ঠ সীমাবদ্ধতা ছিলো এবং প্রেক্ষিত বিবেচনায় তাঁর জন্যে এটি থাকাই স্বাভাবিক ছিলো। তারপরেও তিনি যতটা সম্ভব পরোক্ষভাবে তাঁর মতামত প্রকাশের চেষ্টা করতেন।

সত্য প্রকাশের প্রয়োজনেই এখানে উল্লেখ করতে হবে যে, তিনি শিক্ষকতার বাইরে প্রধানতঃ তিনটি বিষয়ের ক্ষেত্রে দারুণভাবে উৎসাহী এবং আগ্রহী ছিলেন। সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিকে তিনি তাঁর ব্যক্তি জীবনে ভীষনভাবে প্রধান্য প্রদান করতেন। আর রাজনীতি যেখানে থাকবে সামাজিকতা থাকবার বিষয়টিও সেখানে অনিবার্য। সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে তিনি যতটা অলোড়িত করতে চাইতেন এবং পারতেন রাজনীতিকে সেভাবে পারতেন না তাঁর বাথ্যতামূলক সীমাবদ্ধতার কারণে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ এবং নিবিড় সম্পর্ক ছিলো। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অমাদের মধ্যে একেবারেই খোলামেলা আরোচনা হতো। বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে মূলতঃ সাহিত্য, সংস্কৃতির ওপরেই আলোচনা হতো বেশী। তবে সব আলোচনার মধ্যেও রাজনীতি এসে পড়তো। আর আলোচনাগুলিতেই উঠে আসতো তার তাঁর চিন্তা, চেতনা, ভাবনার মতো গভীর বিষয়গুলি। সাহিত্য এবং সংস্কৃতি বিষয়ে ব্যক্তি এবং সমাজ প্রসঙ্গে তাঁর সুদৃঢ় চৈতন্যিক অবস্থান ছিলো ব্যক্তি-ভিত্তিক। মানুষ সামাজিক জীব। একাকী নিঃসঙ্গভাবে কখনই একজন সুস্থ মানুষ যেমন স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারে না-এটিকে যেমন তিনি বিশ্বাস করতেন ঠিক তেমনি একইভাবে বিশ্বাস করতেন ব্যক্তি ব্যতীতও সমাজ গঠিত হয় না।

তিনি বিশ্বাস করতেন যেহেতু ব্যক্তিই সমাজকে নির্মান করে সেইহেতু ব্যক্তিক চৈতণ্য-পরিধির উচ্চ মাত্রার প্রসারন ব্যতীত সমাজের সার্বিক মূল্যবোধকে উর্ধায়িত করা মোটেই সম্ভব নয়। সমষ্ঠিগতভাবে ব্যক্তিক চৈতণ্যের উর্ধায়নই সম্ভব করে তুলতে পারে উন্নততর সামাজিক মূল্যবোধের সুদৃঢ় ভিত এবং ভিত-উপরিস্থিত শক্ত কাঠামোকে। তাঁর এই ধারণা এবং বিশ্বাসকে তিনি বিভিন্ন সভা, সমাবেশ অথবা কোনো সেমিনারে বক্তব্য প্রদানের সময় তুলে ধরতেন অতি স্পষ্ট আকারে। এখানে তাঁর কোনো প্রকারের জড়তা অথবা অস্পষ্টতা কখনই থাকতো না। আর ব্যক্তিক জীবনের সঙ্গে যে সাহিত্য অঙ্গা অঙ্গিভাবে জড়িত এবং একে অপরের সাখে সম্পৃক্ত বিষয়টির অনুকুলে তিনি প্রচুর ইতিবাচক যুক্তিকে উস্থাপন করতেন।

এখানে লক্ষণীয় সামাজিকতাকে সামনে রেখে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সুকান্ত পর্যন্ত সবাই যেন তাদের সাহিত্যকে স্বীয় জীবন-চেতনার মধ্যে দিয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করে গেছেন ব্যক্তি-জীবনের কাছে। জীবন যখনই সামাজিকতার যুক্তিহীন অত্যাচারে চিৎকৃত হয়েছে তখনই যেন সাহিত্য আবির্ভূত হয়েছে চিৎকারের সর্বশেষ সান্ত¡না হিসেবে। এবং পরিণতিতে ব্যক্তি-জীবন যা পেয়েছে তা- সামাজিকতাকে পরাজিত করবার সূর্যিক আনন্দ নিঃসঙ্কোচে। আর সামাজিকতার বিজিত বিগ্রহ আনন্দ থেকে লাভ করেছে নিজেকে সংশোধন করবার জন্য কোষমুক্ত উলঙ্গ কৃপাণের তী²ধারকে। তাই সামাজিকতা যেখানে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারের প্রতিনিধি সেখানে তাকে অস্বীকার না করেই সাহিত্যের প্রতিশ্রুতি হওয়া উচিৎ তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি-জীবনের মূল্যবোধকে বিরামহীনভাবে প্রস্তুত রাখাÑ যেন সে যেকোনো মুহুর্তে সামাজিকতার অসুন্দর, অমঙ্গলতাকে উৎসাদিত করতে পারে ব্যক্তি-জীবনের সার্বিক সুন্দরতার প্রয়োজনেই। কথাগুলিই ছিলো তাঁর দর্শন। এই দর্শনকে তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন।

এখন তাঁর রাজিৈতক দর্শনটির দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। আমি রাজনৈতিক প্রবন্ধ অথবা নিবন্ধ কোনোটিই লিখতাম না। হঠাৎ একদিন সন্ধের পর তপন রুদ্র আমার বাড়ীতে এলেন। অবশ্য সময় পেলেই মাঝে মাঝে তিনি আমর বাড়ীতে আসতেন। তিনি ছিলেন আমার অনুজ প্রতীম। তিনি আমাকে রাজ্জাক ভাই বলেই সম্বোধন করতেন এবং আমি তাঁকে তুমি করেই বলতাম। চা খেতে খেতে সাহিত্য, সংস্কৃতি বিষয়ক আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি রাজনৈতিক প্রসঙ্গটিকে নিয়ে আসলেন। স্বাভাবিকভাবেই আমিও আগ্রহী হয়ে উঠলাম। তিনি যেটি বললেন সেটি হচ্ছেরাজ্জাক ভাই আমি তো রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখি না। আমার পেশাগত কারণেই আমি লিখতে পারি না যেটি আপনি খুব সহজেই করতে পারেন।আমি বললাম কি রকম?”-উত্তরে তিনি যা বললেন সেটি হলোআপনি তো আমার মতো সরকারি চাকুরী যেহেতু করেন না সেইহেতু সরকারি দিক থেকে আপনার কোনো সীমাবদ্ধতাও নেই। আপনি রাজনীতি সচেতন মানুষ, আপনার রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার কথা বিভিন্ন সভা সমাবেশে এবং কোনো সেমিনারে অথবা আলোচনা চক্রে আপনি স্পষ্টভাবেই বলে যেতেন। তো সেই কথাগুলিকেই তো আপনি লিখিত আকারে কোনো দৈনিক অথবা সাপ্তাহিক কাগজে প্রকাশ করতে পারেন। সেটি করলে আপনার চিন্তা, ভাবনা, অপনার আদর্শ ব্যপক মানুষের মধ্যে ছায়া ফেলতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস। দেখছেন তো দেশের অবস্থা! এরশাদ সাহেব মানুষকে মানুষ হিসেবেই গন্য করছেন না। লিখুন না কিছু।তখন ছিলো জেনােেরল এইচ, এম এরশাদের শাসন কাল। তবে সামরিক আইন কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। আলোচনা শেষে তপন চলে গেলো। ওর যাবার পর আমি বেশ কয়েক দিন ধরে অবিরাম বিষয়টিকে নিয়েই চিন্তা করলাম। অমি যদি লিখি তাহলে পরিস্থিতি কী হতে পারে? এখন তো একনায়কতন্ত্র। একজন ব্যক্তির কথাই এখন আইন। এর ডান বাম হবার কোনো পথ খোলা নেই। কয়েক দিন ভাববার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলামÑ আমি লিখবো। এপর আমি আর পেছনের দিকে তাকাই নি।বাংলার বাণী”- নামের একটি দৈনিক পত্রিকা যেটিকে জিয়াউর রহমানের সময় বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো সেটিকে এরশাদের শাসনামলে তিনি কর্তৃক সামরিক আইন কিছুটা শিথিল করবার পর কয়েকটি পত্রিকার সঙ্গেবাংলার বাণী’-কেও পূণরায় প্রকাশের অনুমতি দেয়া হলে পত্রিকাটি আবার আলোর মুখ দেখতে শুরু করে। সেই পত্রিকাটিতেই আমার প্রথম রাজনৈতিক প্রবন্ধআমরা কোথায় চলেছিলেখাটি প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধটি দিয়েই আমার রাজনৈতিক প্রবন্ধ লেখার জগতে পদচারণার শুরু।

এতগুলি কথা এখানে বলবার কারণটি হলো তপন রুদ্রই আমার রাজনৈতিক প্রবন্ধ লেখার পথ প্রদর্শক। তিনিই আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখতে। এটি বলতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা অথবা সঙ্কোচ নেই। অকপটে কথাটি আমি অনেককে বলেছিও। তাঁর সঙ্গে সেদিনের সে আলোচনাটি না হলে আমি হয়তো কোনোদিনই রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখতাম না।  অসংখ্য রাজনৈতিক প্রবন্ধ আমি লিখেছি এবং প্রকাশিতও হয়েছে যা হয়তো কখনই সম্ভব হতো না। এখানে তাঁর কাছে আমি  ঋণী। এবং ঋণ অপরিশোধ্য। তাঁর সেই উৎসাহ এবং প্রেরণা এখনও আমাকে রাজনীতি নিয়ে লিখতে প্রবুদ্ধ করে চলেছে। আমার প্রকাশিত উপন্যাসপ্রাণহীন প্রতিকৃতিএর মৌলিক বক্তব্য পুরোপুরি রাজনৈতিক, আমার আর একটি উপন্যাসপ্রভগৃহ’-রাজনৈতিক, আমার গল্পগ্রন্থের সবগুলি গল্পে মূল ভিত্তি রাজনীতি, কবিতার বইআক্রান্ত নীলাচলএর প্রায় সবগুলি কবিতার চরিত্রই রাজনৈতিক, আমার প্রবন্থ-গ্রন্থের ক্ষেত্রেও একই কথা। তাই আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁকে প্রায় সব সময়ই স্মরন করে চলি। আজকেও আমি তাঁর পবিত্র আত্মার প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

অধ্যাপক তপন রুদ্রের রাজনৈতিক বিবেচনায় যে দর্শনটিকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতেন সেটি হলো প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেলের একটি বিশেষ উক্তি এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের তদানিন্তন চেয়ারম্যাম (চীনা কম্যুনিষ্ট পার্টির) মাও সে তুঙ- ( Mao Tse Tung) এর কয়েকটি কথা  যা নীচে উদ্ধৃত করা হলো

প্রখ্যাত দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেলের- Philosophical Liberalism নিবদ্ধটির প্রথম কথাই হলো-

ÕThe rise of liberalism, in politics and philosophy, provides material for the study of a vary general and very important question, namely what has been the influence of political and social circumstances upon the thoughts of eminent and original thinkers, and conversely, what has been the influence of this men upon subsequent political and social developments?’

অর্থ্যৎ রাজনীতি এবং দর্শনে ‘মুক্তিবাদ’- এর উত্থান অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের চিন্তাবিদদের চিন্তায় রাজনৈতিক ও সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব কতখানি, বিপরীতক্রমে পরবর্তীতে রাজনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সেইসব লোকদের প্রভাব কতখানি, সহজ অর্থে পরবর্তী সামাজিক ও রাজনৈতিক বির্বতনে Eminent and Original thinker -বৃন্দের ভূমিকা কতুটুকু এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক বির্বতনের অনিবার্যতা তাদেরকে কতটুকু প্রভাবিত করতে পেরেছে? দুটি বিষয় এখানে পাশাপাশি সমান্তরাল যা প্রয়োজন এবং প্রয়োজন পূরণের ক্ষমতা। প্রয়োজনের সঙ্গে যখন প্রয়োজন পূরণের ক্ষমতা সৃষ্টি হবে ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে জন্ম নেবে নতুন একটি সংস্কৃতি যা শাখা প্রশাখায় পত্র পল্লবে পল্লবিত হতে থাকবে ক্রমান্বয়িকভাবে, গড়ে তুলবে নবতর সভ্যতারও। Selected works from mao tse tung MÖ‡š’i Volume-IV G D‡jøL Kiv n‡q‡Q The peoples liberation army issued a manifesto in October 1947 which stated in part united workers, peasants, soldiers, intellectuals and businessmen, all oppressed classes all peoples organization, democratic parties minority nationalities, overseas Chinese and other patriots, from a nation united front, overthrow the dictatorial chiang- kai shek government and establish a coalition government’ স্পষ্টতই এখানে লক্ষ্যণীয় যে বিভিন্ন শ্রেণীভুক্ত বিপুল জনগোষ্ঠিকে একটি বিশেষ রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং তার অধিনায়কের বিরুদ্ধে সেই বিশাল জনগোষ্ঠির আকাক্ষা পূরণে ব্যর্থ হŸার কারণেই অত্যন্ত সাবলীলভাবে এবং সুগঠিতভাবে একত্রিত হয়ে চরম আঘাত হেনে সেই সংশ্লিষ্ট অজনপ্রিয় সরকারের পতন ঘটানোর জন্য উদাত্তভাবে আহবান জানানো হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন যেকোনও গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গা প্রসঙ্গে বলেছিলেন- Ò TheGovernmet is- By the people, for the people, Of the people.”- এখন এই কথা ক’টিকে যদি এভাবে বলা যায় Ò The Politics is By the people, For the people, Of the people- তাহলে দেখা যাবে শেষের কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ ‘জনগণের রাজনীতি।’ আর এই শেষের কথাটির ওপরেই অধ্যাপক তপন রুদ্র সবচাইতে বেশী গুরুত্ব প্রদান করতেন। তিনি মনে প্রাণে চাইতেন এই কথাটির বাস্তবায়ন হোক। রাজনীতি যেনো জনগণের হয়। কিন্তু এটি কখনই বাস্তবায়িত হয়নি। জনগণকে  প্রতিশ্রুতি প্রদান করে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পরপরই তাদের সেসব প্রতিশ্রতির কথা অকাতরেই ভুলে যান। জনগণকে তখন তারা মনে করেন তাদের ক্রীতদাস। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই ‘পুতুল নাচের’- মতো করে তাদেরকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। অধ্যাপক তপন রুদ্র এ ধরণের রাজনীতির বিরুদ্ধেই সব সময় তাঁর ভাবনাকে ধারণ করে লালন করতেন। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের বিশেষ একটি দিকই ছিলো এটি। তিনি বিশ্বাস করতেন সাহিত্য ‘জন-রাজনীতিরই’-অত্যন্ত বলিষ্ঠ একটি শাখা। যেহেতু জনগণের জীবন প্রবাহের মৌলিক ধারাটিই সাহিত্যের প্রাণ। কেননা জনগনের জীবনের প্রবাহমানতা ব্যতীত কখনই সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব নয় এবং একই সাথে সাহিত্য সংস্কৃতিকে ধারণ এবং লালন করে। সেদিক থেকে সাহিত্যের দায়িত্ব এবং কর্তব্য বহুমাত্রিক। যে দেশের সাহিত্য যতটা দুর্বল সংস্কৃতিও ঠিক ততটাই দুর্বল। সংস্কৃতিকে স্বাস্থবান, ঋদ্ধিমান করতে গেলে সাহিত্যকে অবশ্যই পরিপুষ্ট হতে হবে। তা না হলে সামাজিক মূল্যবোধ উর্ধায়িত হবে না। এখানে স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত। একটিকে আর একটি থেকে বাদ দিলে দুটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিক মূল্যবোধ সমষ্টিগতভাবে সামাজিক মূল্যবোধকে উর্ধগামী করে নিশ্চিতভাবেই। এটি অধ্যাপক তপন রুদ্রের গোটা দর্শনের আর একটি দৃঢ়তর দিক। এখন অধ্যাপক তপন রুদ্রকে কেবলমাত্র একজন শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করে ফ্রেমবন্দী করলে তাঁর পুরো চরিত্রটি কখনই উন্মুক্ত হবে না। তিনি ছিলেন একাধারে ইংরেজী বিষয়ের একজন সফল শিক্ষক, সুগভীর চিনÍক, জ্ঞান অর্জনের দুরন্ত অশ্বারোহী, অর্জিত জ্ঞানকে মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেবার সাহসী পুরুষ (সীমাবদ্ধতা সত্বেও) এবং জানার আগ্রহে আকুল এক অবিস্মরনীয় তৃষিত সত্তা। তাঁর এই তৃষ্ণার স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন অধ্যাপক হিসেবে কর্ম জীবন থেকে অবসর গ্রহনের পর তাঁর রচিত এবং প্রকাশিত গল্প, প্রবন্ধ এবং কবিতা গ্রন্থগুলিতে। প্রসঙ্গতঃই এখানে আর একটি আপনা আপনিই চলে আসে যেটি তাঁর জ্ঞান আহরনের প্রবল তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধিৎসা। তিনি সব সময়ই চাইতেন ’অন্ত’কে উদ্ধার করতে। তিনি বিশ্বাস করতেন অন্তকে না জানলে অন্তিমকে জানা সম্ভব নয়। অর্থাৎ উৎসকে জানতে না পারলে সমাপ্তি সম্পর্কেও কিছু জানা যাবে না। আর এ জন্যে তিনি প্রচুর পড়াশুনা করতেন। রাত দিন একাকার করে তিনি অবিরাম জাতিয় এবং আন্তর্জাতিক অসংখ্য গ্রন্থ তিনি পাঠ করে যেতেন তাঁর চোখের দৃষ্টিশক্তিতে সমস্যা থাকবার পরেও এবং এ বিষয়টিকে তিনি গ্রাহ্যই করতেন না। এবং এই পাঠের মর্মস্থিত মূল লক্ষটি ছিলো তাঁর জ্ঞান অর্জনের দুর্নিবার তৃষ্ণা-নিবৃত্তি। কিন্তু তাঁর এই তৃষ্ণা এবং সে তৃষ্ণা পুরিত না হবার বিষয়ে কিছু কথা বলা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয় বলে অবশ্যই গ্রহন করা যেতে পারে। এই কথা ক’টি না বললে তাঁর জানবার গোটা বিষয়টি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। শুধুমাত্র সে কারণেই কথা ক’টি বলা হচ্ছেÑ তৃষ্ণার উপান্তে দাঁড়িয়ে অন্ত উদ্ধারের অভিলাষসিক্ত হয়েÑ উপান্তে দাঁড়ানোর অনুক্রমে তৃষ্ণার অতিক্রান্ত ব্যবধানের তৃপ্ততাকেও উত্তীর্ণ করে যায়। অন্ত উদ্ধারের অন্তিম আকর্ষণ এতক্ষণের সমগ্র সুখময়তাকে অলীক আচ্ছন্নতার মতো স্ফূর্তিহীন, উত্তাপবিহীন, অতিরিক্ত কোন কিছুর সাথে যেন তুলনীয় করে তোলে। আর তখনই স্পৃহার অনির্বাপিত শিখা কল্পনাকেও অতিক্রম করবার দূর্বারতা লাভ করে। অর্থাৎ সমগ্র তৃষ্ণা পরিক্রমনে স্পৃহা তিলে তিলে তৃষ্ণার বিন্দুসম অঞ্চল উদ্ধারে প্রতিক্ষণে যে শক্তি অপচয় করে উপান্ত্য স্পর্শের স্থিতির লগ্ন পর্যন্ত সেই শক্তির প্রতিটি পরমানু যেন আবার একই বৃত্তে কে›ন্দ্রীত হয়ে অন্তের বিরুদ্ধে স্পৃহাকে দ্বিগুন মাত্রায় কার্যকর করে তোলে। কিন্তু যখন এ দ্বিগুন শক্তির প্রচন্ড আক্রমন রচনা করেও অন্ত উদ্ধারের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের মিছিলে বীর্যহীন হয়ে পড়ে তখনই স্পৃহার উন্মাদনা রূপান্তরিত হয়ে যায় অসহায় বিলাপ মিশ্রিত সকরুণ ব্যাকুলতায়। রবীন্দ্রকাব্যের নির্দিষ্ট কতগুলি সৃষ্টি যেন এ সকরুন ব্যাকুলতার নক্ষত্র-প্রতিভাস। অধ্যাপক তপন রুদ্র যেনো সেই তৃষ্ণার উপান্ত্যে দাঁড়িয়ে শুধু তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অন্তকে অবলোকনই করেছেন তাঁর নিজের মতো করে, উদ্ধার করতে পারেননি যা বোধকরি কারুর পক্ষে সম্ভবও নয়। আর এই না পারবার দূর্বলতা যেন চূর্ণ অনুভূতি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে তার সৃষ্টির অঙ্গ প্রত্যঙ্গে। প্রকারান্তরে সেটিকেও তাঁর একটি বড় মাপের সাফল্য বলেও ধরে নেয়া যায় এ কারণে যে, অন্ত-উদ্ধারের নেপথ্যে যে চৈন্তিক নির্ঝরিনীর প্রবহমান প্রচন্ড গতিশীলতা-বাহিত প্রচেষ্টা সেই প্রচেষ্টাটিই মূলতঃ তাঁর সফলতা যা তিনি তাঁর সারা জীবনব্যপী করে গেছেন। অর্জন অথবা অনার্জন হলো দ্বিতীয় স্তর: প্রথম স্তরটি হলো প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টাটিতে তিনি অবশ্যই সফল। এই হলো একজন অধ্যাপক তপন রুদ্রের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বহুমাত্রিক দর্শন-তাত্বিক অবস্থান। আমি তাঁর আত্মার প্রতি যথাযথ সম্মান এবং শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তাঁর পবিত্র আত্মার শান্তি কামনা করছি। তিনি অনন্ত জীবনে প্রস্থান করলেও তিনি এবং তাঁর দর্শন আমাদেরকে সঠিক পথটি প্রদর্শন করবে চিরকালীনভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মান্তরে। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে কালানুক্রমিক ধারায় যুগ যুগ ধরে।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান